নারী পাচারকারী ফটিকছড়ির আজম খান দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার

নারী পাচারকারী ফটিকছড়ির আজম খান দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার
নারী পাচারকারী ফটিকছড়ির আজম খান দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

ঢাকায় সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হল ফটিকছড়ির আজম খান ও তার দুই সহযোগী। তাঁর স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আজম খান ও তার সহযোগীরা গত আট বছরে সহস্রাধিক তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার করে ‘যৌনকর্মে বাধ্য করেছে’। দুবাইয়ে তার চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেল রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত ২ জুলাই লালবাগ থানায় সিআইডি বাদী হয়ে একটি মামলা করে। সেখানে আজমকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ঢাকার পাশের এক জেলা থেকে তাদের তিনজনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে ৪৫ বছর বয়সী মো. আজম খান এই চক্রের ‘হোতা’। ৪৫ বছর বয়সী আলামিন হোসেন ডায়মন্ড এবং ৩৫ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন ময়না তার সহযোগী। সিআইডির ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘দুবাইয়ের ফরচুন পারল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়্যাল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড এবং হোটেল সিটি টাওয়ারের অন্যতম মালিক আজম। বিভিন্ন ক্লাব ও হোটেলে কাজ দেওয়ার নামে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অল্পবয়সী সুন্দরী তরুণীদের পাচার করে দুবাইয়ে নিত সে। তারপর সেখানে তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হত।’
সিআইডির নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে- আলামিন ও এই চক্রের অন্যরা নাচের প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণীদের বিদেশে মোটা অঙ্কের বেতনে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। এদের প্রধান লক্ষ্য নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণীরা। এমন তরুণীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সেখানে নিয়ে তাদের যৌন পেশাতেও বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র মতে, তরুণীদের সংগ্রহ, পাসপোর্ট করানো, ভিসা সংগ্রহ, বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন পার করানো এবং আরব আমিরাতে ‘ড্যান্স বারে’ পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সবখানে এই পাচারকারী চক্রের বিশ্বস্ত এজেন্ট রয়েছে। বারে নৃত্য পরিবেশনের নাম করে নেওয়া হলেও সেখানে পৌঁছানোর পর আজমের মালিকানাধীন হোটেলগুলোতে আটকে রেখে তাদের ওপর যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হত। মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গেলেও এ চক্রটি ভিকটিমদের কোনো টাকা দেয়নি বলেই অভিযোগ রয়েছে। পাচারের শিকার নারীরা জবানবন্দি দিয়েছেন জানিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এছাড়া ডান্স বারে নির্যাতিত নারীদের বাঁচার আকুতি জানানোর বেশ কিছু অডিও ক্লিপ সিআইডির হাতে এসেছে। এসব অপকর্মের কারণে আমিরাত সরকার আজমকে ২০০৭-২০০৮ সালে ব্ল্যাকলিস্টেড করে দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে এসে সে আত্মগোপনে চলে যায়, পরে নতুন করে পাসপোর্ট করে ওমান হয়ে দুবাই ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তিনি বলেন, গডফাদার আজম খান দালালের মাধ্যমে নারীদের সংগ্রহ করতেন। এ কাজে আজম খানকে সহযোগিতা করেছে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি ও বিদেশি বিমান সংস্থা। তিনি ছাড়াও দুবাইয়ে তাঁর সঙ্গে দুই ভাই যুক্ত ছিলেন এ কাজে। তার অবর্তমানে এই ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল তার ভাইয়েরা বলেও সিআইডি জানতে পেরেছে। রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের অনেকে।
দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে পাঠানোর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন তাকে গ্রেপ্তার করেনি জানতে চাইলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের ইনফরমেশন পেতে দেরি হয়েছে। এর মধ্যেই সে দেশে এসে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে পরে দূতাবাস আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, পাঁচটি ধাপে দুবাইয়ের ডান্স বারে নারীদের পাচার করা হয়। প্রথম ধাপে রয়েছে এজেন্ট। তাদের কাজ হচ্ছে মেয়েদের টার্গেট করা এবং তাদেরকে প্রলোভন দেখানো। এর সাথে দুবাই ফেরত কিছু নারীও জড়িত রয়েছে। কারণ তাদের মুখে ‘আর্থিক সমৃদ্ধির গল্প’ অন্য নারীদের প্রলুব্ধ করে।
দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে পাসপোর্ট করিয়ে দেবার দালালচক্র। মেয়েদের রাজী করানো সম্ভব হলে দালালরা তাদের পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করে। মেয়েদের ছবি পাঠানো হয় দুবাইয়ে ডান্স বারের মালিকদের কাছে। ছবি দেখে পছন্দ হলে মালিকরা ঢাকায় আসে তাদের দেখার জন্য। তৃতীয় ধাপে রয়েছে ট্রাভেল এজেন্ট। তাদের কাছে ট্যুরিস্ট ভিসা পাঠিয়ে দেয় দুবাইয়ের ডান্স বারের মালিকরা। পরবর্তী ধাপে আছে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসাধু ব্যক্তি। একজন নারী ইমিগ্রেশন পেরিয়ে দুবাই যাবার জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। একজনকে পাঠাতে দুই লক্ষ টাকার বেশি খরচ হয়, যার পুরোটাই বহন করে ডান্স বারের মালিকরা। দুবাইয়ে পৌঁছানোর পর একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় এ নারীদের। তারপর সেখান থেকে কোনো বাড়িতে নিয়ে কার্যত বন্দী করা হয় এবং দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়।