ডেঙ্গু আক্রান্ত কমছে আতঙ্ক কমেনি

এম মামুন হোসেন ।।

ডেঙ্গু আক্রান্ত কমছে আতঙ্ক কমেনি
ডেঙ্গু আক্রান্ত কমছে আতঙ্ক কমেনি
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে আসছে। শনিবার নতুন করে আরও ১৬৪৯ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর মধ্যে শনিবার ভোরে মাদারীপুরে এক নারী ও বরগুনায় শুক্রবার রাতে তাওহীদ নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার ১৬৮৭ জন এবং আগের দিন বৃহস্পতিবার ১৭১২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ৯১৯ জন। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ হাজার ৮৫৮ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ হাজার ৪৩ জন। আক্রান্তের হার কমে এলেও ডেঙ্গু আতঙ্কে সুস্থ মানুষও হাসপাতালে আসছেন। একটু গা গরম ভাব হলেই রক্ত পরীক্ষা করছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বুধবার ৪৬৫ জনের রক্ত নিয়ে এনএস-১ পরীক্ষা করার পর মাত্র ১৬ জনের ডেঙ্গু রোগের নমুনা পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগ নিয়ে দেশে একটা প্যানিক তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর খবরে একটু অসুস্থতা নিয়েই হাসপাতালে আসছেন তারা।
 
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ডেঙ্গুর আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে আসছেন অনেক সুস্থ মানুষও। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগেরই রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গুর নমুনা পাওয়া যায়নি। তবে সচেতন থাকাটা ভালো।
 

ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫৪ জন। কয়েকদিন একই সময়ে দুইশর বেশি ছিল। এই হাসপাতালে জুলাইয়ে ১০ জন আর জুনে ১ জন মিলিয়ে ডেঙ্গুতে ১১ জন মারা গেছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ঢামেকে ৬৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। প্রতিদিনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন আক্রান্তরা। ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ জন ডেঙ্গু রোগীকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে গত দুই দিন ধরে রোগী ভর্তির সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী বেড়েছে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৯৬৯ জন রাজধানীতে। তার আগে শুক্রবার ৯৯৬ জন এবং বৃহস্পতিবার ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ১৫০ জন। শুক্রবার ৬৯১ জন ভর্তির হয়েছিল দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে, শনিবার পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৬৮০ জন।
 

এদিকে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিকালে রাজধানীর শিশু হাসপাতাল পরিদর্শনকালে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। শিশু হাসপাতালে গতকাল ১৭৩ জন ভর্তি হয়, এর মধ্যে ৭ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। শিশু হাসপাতলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা সেল করা হয়েছে। এখানে এ জ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসা বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ডেঙ্গু সেল পরিদর্শন ও রোগীদের খোঁজখবর নেওয়ার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আসছে বলে মনে করি। মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ভালো কাজ করছে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করলে মশা কমে যাবে। আর মশা কমে গেলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিও ভালো হয়ে যাবে।
 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান খান সময়ের আলোকে বলেন, সব জ্বর ডেঙ্গু নয় এবং প্লাটিলেট সংখ্যা কমে গেলেই তা ডেঙ্গু নয়। রোগ নির্ণয়ের দায়িত্বটা চিকিৎসকদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। চিকিৎসার জন্য এমবিবিএস ডাক্তার যথেষ্ট, জটিল হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সঠিক কর্মপদ্ধতির জন্য সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করতে হবে। ধারণা থেকে বা উপসর্গ দেখে ডেঙ্গু বলা যাবে না। ডেঙ্গু রোগে কী করণীয়, তা আমরা সবাই জানি মৃত্যুর হারও খুবই কম। আতঙ্কিত না হয়ে সবাই মিলে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু রোগ পালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ যেন পরীক্ষানির্ভর সঠিক চিত্রটি জানতে পারে। তাহলে আতঙ্ক বা হতাশা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুল। তিনি বলেন, জ¦র হলে বা ডেঙ্গু হলে বাড়ি যাওয়া যাবে না, এটি মোটেই সঠিক নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে নিজস্ব মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে, খুব কম বাড়ি আছে যারা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মশক নিধন কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যথেষ্ট সক্ষম। ঈদে মানুষ বাড়িতে যাবেই ফেরানোর কোনো সুযোগ নেই। তার চেয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলেই যথেষ্ট হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রি-এজেন্ট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অতি দ্রæত সঠিক ওষুধ ক্রয় করে ব্যাপক মশক নিধন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। চিকিৎসার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকবে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন মতামত থেকে বিরত থাকতে হবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়, এমন খবর থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকার বা সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে সামাজিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান করতে হবে।

প্রথমে রাজধানীকেন্দ্রিক ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর ঢাকার আশপাশের জেলা ও সিটি করপোরেশনে ছড়ায়। এক এক করে দেশের ৬৪ জেলায়ই ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। উপজেলা শহর এমন কী এখন গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫ হাজার ৫৫১ জন। ওই বছর মৃত্যু ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০১ সালে আক্রান্ত ২ হাজার ৪৩০; মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন; মৃত্যু ৫৮, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন; মৃত্যু ১০, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৪৩৪; মৃত্যু ১৩, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন; মৃত্যু ২৬ জন। দেশের কয়েকটি জেলার সর্বশেষ ডেঙ্গু পরিস্থিতি জানিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা:মাদারীপুর : কালকিনি উপজেলায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শনিবার এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম নাদিরা বেগম (৪০)। ভোরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। নাদিয়া উপজেলার পৌর এলাকার উত্তর কৃষ্ণনগর গ্রামের আলমগীর মোড়লের স্ত্রী।

বরিশাল : শেবাচিমে ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন নারী ও শিশুসহ ৩৫ জন। শনিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শেবাচিমে চিকিৎসারত রোগীর সংখ্যা ১৩৯ জন। রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গু শনাক্তকরণের প্রাথমিক উপকরণ কিটসের (এনএসওয়ান) অভাবে পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের।

 
নীলফামারী : গত ২ দিনে নতুন করে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী হাপতালে ভর্তি হয়েছেন। এরা হলেনÑ শাহাবুদ্দিন, কাজী আসাদুজ্জামান, সোহেল খান, মাহবুব হাসান, কাবিরা ইয়াসমিন ও শামীম আহম্মেদ।
 
জামালপুর : বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ পাঁচজন রোগী শনাক্ত করেছেন। যাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে তাদেরকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত পাঁচজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে।
 
সাতক্ষীরা : শনিবার পর্যন্ত ৪৩ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও পর্যন্ত ভর্তি রয়েছেন ২৪ জন বলে সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে। অন্যত্র রেফার করা হয়েছে দুজনকে। আক্রান্তদের সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, কলারোয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
 
জামালপুর : জেনারেল হাসপাতালে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শনিবার একজন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় এবং তিনজন রোগীর অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাদেরকে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
 
ঝালকাঠি : রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ৪ দিনে আটজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। শনিবার সকালে রবিন ও সোলায়মান সুস্থ হলে তাদের ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়।
 
গাইবান্ধা : ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শনিবার পর্যন্ত গাইবান্ধা সদর আধুনিক হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে সিভিল সার্জন জানিয়েছে, গোটা গাইবান্ধা জেলায় এ পর্যন্ত ১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা গেছে।
 
রংপুর : ১৯ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ১১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রমেক হাসপাতালে ভর্তি হলেও ২০ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯২ জন ভর্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭৬ জন পুরুষ, ১১ জন নারী ও ৫ জন শিশু।
 
কুমিল্লা : মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। সব মিলিয়ে জুলাইয়ের ২২ তারিখ থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৩২ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসে।