চার যুগ পর বাবা ফিরলেন

চার যুগ পর বাবা ফিরলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

১৯৭২ থেকে ২০২০ এ সময়ের স্রোতে বয়ে গেল জীবনের মুল্যবান ৪৮টি বছর। স্ত্রী-সন্তানকে রেখে ৩০ বছরে বয়সে ব্যবসায়িক  কাজের উদ্দেশ্য বের হয়ে আর ঘরে ফেরা হয়নি গত ৪৮ বছরে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে জীবনের এত দীর্ঘ পথচলায় সবাইকে  ছাড়া একাই কাটিয়েছেন জীবনের সুবর্ণ সময়ের সেরা মুহুর্তগুলো! এই ৪৮ বছরে বদলেছে দেশ উত্থান পতন হয়েছে পরিবারে। কিন্তু হারানো সেই বাবার জন্য পরিবারের সবার মনে রয়ে গেছে মনের গহীন অন্তরে ভালোবাসা। অবশেষে দীর্ঘ চার যুগ পর  পাওয়া গেল হারানো সেই বাবাকে!

বলছি ৪৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সিলেটের বিয়ানীবাজারের বেজগ্রামে হাবিবুর রহমানের কথা। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই  চার সন্তানের জনক হাবিবুর ব্যবসার কাজে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। এরপর  কালের কেয়াই কেটেছে ৪৮টি বছর। বর্তমানে তার বয়স ৭৮ বছর। চার যুগ পরে গতকাল (১৭ জানুয়ারি) অবিশ্বাস্যভাবেই তাকে খুঁজে পায় তার পরিবার। যখন তিনি হারিয়ে যান তখন তার ঘরে চার সন্তান। এরমধ্যে ছোট ছেলের বয়স ছিল মাত্র ৪০ দিন। সেই ছেলের ঘরে এখন আছে বৌ ও তার দুই সন্তান! তার বড় ভাইদের ছেলে-মেয়ে আছে।

হারিয়ে যাওয়ার পর অনেক বছর খোঁজাখুঁজি করেও না পাওয়ায় হাল ছেড়ে দেন পরিবারের সদস্যরা। এরিই মধ্য  স্বামীর অপেক্ষায় প্রহর ঘুনতে ঘুনতে ২০০০ সালে  মৃত্যু বরণ করেন তার স্ত্রীও।

এরইমধ্যে গত ১৬ জানুয়ারি তার যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী পুত্রবধূর কাছে একটি ফেসবুক ভিডিও আসে, যাতে দেখা যায় হাবিবুর রহমান নামের এক বৃদ্ধ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং যার গল্প অনেকটা হারিয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মিলে যায়।

এটি দেখে তিনি দেশে থাকা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হন যে ভিডিওতে থাকা এই ব্যক্তিই তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা।

পরদিন সকালে হাসপাতালে আসেন হাবিবুর রহমানের দুই ছেলে শাহাব উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন। কথাবার্তার পর তারা তাদের বাবার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, হাবিবুর রহমানের চার ছেলে। তারা হলেন সাহাবুদ্দিন (৬০), মাহাতাব উদ্দিন (৫৮), জালাল উদ্দিন (৫০) ও আলীম উদ্দিন (৪৮)। তাদের মধ্যে মাহাতাব উদ্দিন ও আলীম উদ্দিন পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে থাকেন। সাহাবুদ্দিনের বড় ছেলে তাহির হোসেনও স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। হাবিবুর রহমানের হারিয়ে যাওয়ার কথা তার পরিবারের সদস্যরা জানতেন। তারাও বিভিন্নভাবে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে হাবিবুর রহমানের নাতি তাহির হোসেনের স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক বৃদ্ধের ভিডিও দেখতে পান। বিষয়টি তিনি স্বামীকে জানিয়ে বাংলাদেশে পরিবারের স্বজনদের ভিডিওটি কাছে পাঠান। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে জালাল উদ্দিন গতকাল শুক্রবার সকালে চলে যান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। জালাল উদ্দিন নিশ্চিত হন, হাবিবুর রহমানই তাঁর হারিয়ে যাওয়া বাবা। দীর্ঘদিন পর বাবাকে ফিরে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন জালাল উদ্দিন।

যেভাবে হাসপাতালে
প্রায় ১০-১২ বছর ধরে বার্ধক্যের কারণে প্রায় শয্যাশায়ী হাবিবুর রহমান। এর মধ্যে মাসখানেক আগে বিছানা থেকে পড়ে গেলে তার ডান হাত ভেঙে যায়। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তির পর গত সপ্তাহে ভাঙা হাতে ইনফেকশন দেখা দিলে চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

গত ১৫ জানুয়ারি হাবিবুর রহমানের ভাঙা হাতের অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। কিন্তু, প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় রাজিয়া বেগম অপারেশন করাতে পারেননি।

যেভাবে ফেসবুকে জানাজানি
টাকার অভাবে হাবিবুরের হাতে অপারেশন করতে পারছিলেন না রাজিয়া বেগম। সেসময় হাসপাতালের পাশের বেডে থাকা এক রোগীর আত্মীয় হাবিবুর রহমানের গল্প জানতে পারেন।

তিনিই হাবিবুরের ছবি তুলে ও সামগ্রিক বিষয় লিখে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন যা ধীরে ধীরে শেয়ার হতে থাকে দেশে-বিদেশে। আর এভাবেই একসময় হাবিবুরের যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী পুত্রবধূর কাছে পৌঁছে যায়।

পারিবারিক পুণর্মিলনী
গতকাল সকালে পরিবারের সদস্যরা ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে হাবিবুরকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। তবে হাবিবুর শুধু নিজের স্ত্রী ও ভাইদের নাম এবং গ্রামের নাম বলতে পেরেছিলেন।

একসময় পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হন, ইনিই তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা হাবিবুর রহমান। তারপর তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান বেসরকারি আল-হারামাইন হাসপাতালে।

বর্তমানে সেই হাসপাতালের ৬ তলার একটি কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। আর এখানেই আসতে থাকেন তার পরিবারের সদস্য এবং স্বজনেরা। ছেলে জালাল উদ্দিন বলেছেন, প্রায় ৪৮ বছর পর বাবাকে ফিরে পেয়ে আমরা যেমন খুশি, আমাদের সন্তানেরা তার চেয়ে বেশি খুশি। তারা তো বিছানার পাশ থেকে সরতেই চায় না।

নাতি কেফায়াত আহমেদ বললেন, ছোটবেলা থেকে দাদার গল্প শুনেছি বাবা-চাচাদের কাছ থেকে। কখনও ভাবিনি তাকে ফিরে পাবো। কিন্তু, খুব আশা ছিলো একদিন ফিরে পাবো। আজ তা পূরণ হয়েছে। খুব খুশি লাগছে। তিনি কেনো এতো বছরেও বাড়ি ফিরে আসেননি সে সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে পরিবারের সদস্যদের মতে, হাবিবুর রহমানের কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।

যেমন আছেন তিনি এখন

হাবিবুর রহমানে । ছবি সময়ের আলো

হাবিবুর রহমানে ।

 শনিবার দুপুরে দেখা গেছে, বেসরকারি ওই হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষে চিকিৎসা চলছে হাবিবুর রহমানের। তাকে দেখতে কক্ষটিতে ছিল স্বজনদের ভিড়।ছেলে জালাল উদ্দিন ব্যস্ত বাবার চিকিৎসার ওষুধপত্র সংগ্রহে। বড় ছেলে সাহাবুদ্দিনের ছেলে জামিল হোসেন ব্যস্ত স্বজনদের সামাল দিতে। শয্যাশায়ী হাবিবুর রহমানকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। তিনি কথা বলছেন অল্প। স্ত্রী, নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা বলছেন হাবিবুর রহমান। তবে বেশির ভাগ সময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছেন তিনি।- সময়ের আলো ।