সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং আমার ভাবনা - ডাঃ মোঃ নুর উদ্দিন

সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং আমার ভাবনা - ডাঃ মোঃ নুর উদ্দিন
ডাঃ মোঃ নুর উদ্দিন

সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক।।

ডাঃ মোঃ নুর উদ্দিন রাশেদ ২০১৯ খ্রিঃ এর অক্টোবর মাসে সীতাকুন্ড উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন । যোগদানের এই দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি সস্প্রতি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন , যা উপস্থাপন করা হলো । তিনি লিখেন,

গত ২০১৯ খ্রিঃ এর অক্টোবর মাসে আমি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সীতাকুণ্ড চট্টগ্রামে UH & FPO পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলাম।

আজ জুলাই এর ১৯ তারিখ। চোখের পলকেই হয়তো তিনটি মাস কেটে যাবে আর হবে, আমার এই পদে দায়িত্বপালনের ১ বছর পূর্তি।

আমি গতরাত থেকেই ভাবছিলাম, আমি কি সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজিয়ে, স্বাস্থ্যবিভাগের চলমান উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখতে আমার যে স্বপ্ন তা থেকে সরে এসেছি? নাকি সঠিক পথেই আছি? এ পর্যন্ত আমি কি করতে পেরেছি স্বাস্থ্য বিভাগের আধুনিকায়ন এবং এর গতিশীলতা বাড়াতে বা ধরে রাখতে?

এসব নানান প্রশ্নে যখন আমি চিন্তিত, আমারই এক সহকর্মী আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি কি কোন কারণে চিন্তিত কিনা। আমি আমার চিন্তার কারণ শেয়ার করার পর সে আমাকে জানালো, আমাদের কাজের অগ্রগতির কথা। যেগুলো করতে গিয়ে আমার ঘাম ঝরেছে, নানান জায়গায় অনুরোধ করতে হয়েছে, চিঠি লিখতে হয়েছে উর্ধ্বতন নানান কর্তৃপক্ষের কাছে, অংশগ্রহণ করতে হয়েছে নানান মিটিং সভা সেমিনারে।

কিন্তু চলমান কাজের চাপে এবং করোনাকালীন দুঃসময়ে আমি শুধু এগুলো নিয়েই যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমার স্বপ্ন সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো বহুদূর নিয়ে যাওয়া।

এই এক বছরে সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে কি করেছি-

১➤ আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন যোগ হয়েছে হাসপাতালে। এয়ারকন্ডিশনার চলে এসেছে। শুধু ইন্সটলেশন সমাপ্ত হলেই হাসপাতালে আগত রোগীদের হাসপাতালেই স্বল্পমূল্য ও সরকার নির্ধারিত ফিতে নির্ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম করা সম্ভব হবে।

২➤ আগামী এক মাসের মধ্যে সীতাকুণ্ড হাসপাতালে যোগ হতে যাচ্ছে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন। ইতিমধ্যে টেকনিক্যাল টিম তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিছু যন্ত্রাংশও চলে এসেছে। ইন্সটলেশন সম্পূর্ণ হলেই স্বল্পমূল্যে ও সরকার নির্ধারিত ফি তে মানসম্মত ডিজিটাল এক্সরে সেবা হাসপাতালেই পাবে রোগীরা।

৩➤ আগামী এক মাসের মধ্যে হাসপাতালে চলে আসবে জেনেক্সপার্ট মেশিন। যা দিয়ে নির্ণয় করা যাবে মাল্টি ড্রাগ রেজিষ্টেন্ট যক্ষা রোগ এবং ভিন্ন রিএজেন্ট ব্যবহার করে যে মেশিন এখন করোনা পরীক্ষায় ও ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪➤ আমি যোগদানের পর পরই দেখছিলাম, হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগীরা বিভ্রান্ত ও হয়রানির স্বীকার হচ্ছে। আমার একার পক্ষে এটা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমি মাননীয় সাংসদ আলহাজ্ব দিদারুল আলম এমপি এমপি মহোদয়ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাননীয় জনাব Alhaj SmAl Mamun মহোদয় এর দ্বারস্থ হলাম। ওনার পরামর্শক্রমে পুরো হাসপাতাল জুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগালাম। আমি নিজে সেটা সবসময় মনিটরিং করি। আর দালাল দের দেখা মাত্রই সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত হয়ে বা কাউকে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিই। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল সিসিটিভির আওতায় আছে এবং হাসপাতাল সম্পূর্ণরূপে দালালমুক্ত। এই ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের অবদানও অনস্বীকার্য।

৫➤ হাসপাতাল আধুনিকায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য হাসপাতালের একটি প্রকাশ্য অংশে বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারী করেছি।
০৬. হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে একটি নিয়ন সাইন টিভি স্থাপন করেছি। যাতে হাসপাতালের সেবা সমুহ দেখানো হচ্ছে।
০৭.হাস্পাতালের প্রবেশ করতে বেসিন স্থাপন করা হয়েছে।
০৮.হাস্পাতালের হেল্প ডেস্ক করেছি।
০৯.প্রতিবন্দ্বীদের জন্য চলাচল সুবিধার্তে বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১০. হাস্পাতালে যোগদানের পর মসজিদের নতুন অজুখানার ব্যবস্থা করেছি।
১১.প্রতিবন্দীদের জন্য সম্পুর্ন একটা আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করেছি সংযুক্ত প্রতিবন্দী বান্দব বাথরুম সহ সাথে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যা উদ্দ্বোধনের অপেক্ষায়।
১২.হাস্পাতালের ২য় তলায় মহিলাদের নামাজের আলাদা কক্ষ করেছি।
১৩➤ হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই দেখে আসছিলাম, রোগীদের সুপেয় পানির অনেক সমস্যা। তারা হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের নতুন টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে।
১৪. বহির্বিভাগ রোগীদের জন্য মহিলা ও পুরুষের আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৫➤ হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে দেখলাম অপারেশন থিয়েটারের কিছু মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অচল /নষ্ট, সেইসব চাহিদা মতে প্রাপ্তি।জনবলের জন্য চাহিদা প্রেরিত।

১৬➤ আমি দায়িত্ব নেবার পর দেখেছিলাম, হাসপাতালের কিছু অংশের দেয়াল ভাঙা, যার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঝুঁকিতে ছিল, পাশাপাশি হাসপাতালের গেইট টি যথেষ্ট মানসম্মত ছিলো না। অচিরেই শুরু করা হবে হাসপাতালের জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন গেইট, যা অন্যান্য উপজেলা হাসপাতালের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
১৭.হাসপাতালে বর্তমানে কোভিড ১৯ রোগীদের জন্য
১০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু আছে।

১৮➤ করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য ২০ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে রোগীদের সুবিধার্তে মাননীয় সাংসদ সদস্য জনাব আলহাজ্ব দিদারুল আলম এম পি মহোদয়ের ব্যবস্থাপ্নায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন এর ব্যবস্থা করন অচিরেই উদ্দ্বোধনের অপেক্ষায়।
১৯.পালস অক্সিমিটার, নেবুলাইজার, সাকার মেশিন সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংযোজন করা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ডের জন্য।

২০➤ এছাড়াও হাসপাতালের বহির্বিভাগের ওয়েটিং বেঞ্চ স্থাপন, করেছি ডিজিটাল নিয়ন টিভি, যেখানে সার্বক্ষণিক নানান স্বাস্থ্য বার্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নানান তথ্যচিত্র এবং সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক নানান উন্নয়ন কর্মকান্ডের দিক দেখানো হচ্ছে।

২১➤ আকিলপুর এবং টেরিয়াইল কমিউনিটি ক্লিনিক দুটো বহু পুরোনো হওয়ায়, ভবনগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেগুলো ভেঙে ফেলে একই জায়গায় নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। খুব শীঘ্রই খুলে দেয়া হবে নতুন ভবন।দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পুর্ন নতুন ও তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক নতুন করে মেরামত করা হয়েছে, সাথে আরো তিনটি প্রস্তাবিত আছে।
২২.মহিলাদের জরায়ু ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিনামূল্যে স্ক্রিনিং টেষ্ট করা হয় যা চলমান রয়েছে এবং সচেতনামূলক বিশেষ ক্যাম্প করা হয় যার মাধ্যমে ৭৬০ জনের মত মহিলা সেবা গ্রহন করেন।
২৩.পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বর্ধিতকরন সহ।সুন্দর একটি বাগানের মাধ্যমে হাসপাতালের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরন।
২৪. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষ জোরদার করণ।
২৫.হাস্পাতালে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তিনজন পরিচ্ছন্ন কর্মী রেখেছি।
২৬.হাসপাতালে করোনা রোগীর স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপন যাতে সহযোগিতা করেছেন মাননীয় সাংসদ সদস্য জনাব আলহাজ্ব দিদারুল আলম এম পি মহোদয়।
২৭.প্রতিমাসে চিকিৎসক নার্স এবং সকল কে নিয়ে বৈজ্ঞানিক সেমিনারের আয়োজন করা।

➤ তাছাড়া হাসপাতালের বিভিন্ন রুটিন কাজকর্ম ও সেবা কার্যক্রম যেমন-গর্ভবতী মায়েদের এন্টিনেটাল চেকআপ, প্রসব পরবর্তী পোস্ট ন্যাটাল চেকআপ, নবজাতক ও শিশুদের আইএমসিআই কার্যক্রম এই করোনাকালেও থেমে নেই।

সীতাকুণ্ড হাসপাতালে ০৫ জন চিকিৎস ০২ জন নার্স সহ বিভিন্ন বিভাগের ১৫ জন কর্মী করোনা আক্রান্ত হলেও সব গুলো বিভাগই সচল রেখে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি বিশেষ ব্যবস্থায়। এজন্য আমার চিকিৎসক এবং অন্যান্য সহকর্মীদের অতিরিক্ত দায়িত্বসহ দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে, আমি চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য বিভাগের এতো উদ্যমী, কর্মঠ ও চৌকষ একটি কর্মীবাহিনী পেয়েছি, যারা আমার কথা মেনে স্বাস্থ্য বিভাগের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে এতোটা অমানবিক ও অমানুষিক শ্রম দিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ধরে রাখতে আমার পাশে ছিলেন এবং আছেন। তাদেরকে আমি জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

এ সংক্রান্ত সকল কাজে আমাকে যে সাহস যুগিয়েছেন এবং পরামর্শ ও লজিষ্টিক্স সাপোর্টসহ নানান ভাবে সহযোগিতা করেছেন তার কথা না বললেই নয়, তিনি আমাদের মান্যবর পরম শ্রদ্ধেয় ও সুযোগ্য সিভিল সার্জনDr Sk Fazle Rabbii স্যারের ছায়া এবং মান্যবর পরিচালক স্বাস্থ্য চট্টগ্রাম বিভাগ জনাব ডাঃহাসান শাহরিয়ার কবির স্যার যথা সময়ে যথোপযুক্ত সাপোর্ট ও পরামর্শ না পেলে, বিগত মাত্র ১ বছরেই সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এতোটা মানোন্নয়ন আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
ধন্যবাদ জানাই সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মিল্টন রায় মহোদয়কে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়ক পরামর্শ প্রদানের জন্য।
ধন্যবাদ সকল মিডিয়াকর্মী, সংবাদমাধ্যম এবং সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবসহ সকলকে।

কিন্তু আমি এখনো সন্তুষ্ট নই। আমি চাই সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরো মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। যাতে সীতাকুণ্ড মানুষ সীতাকুণ্ড বসেই অধিকতর উন্নত ও মানসম্মত সেবা পায়। চিকিৎসা নিয়ে যাতে তাদের কোন হয়রানির স্বীকার না হতে হয়।

এসকল কাজে আমি আরো স্মরণ করি আমার সহকর্মী এক ঝাঁক কর্মী বাহিনীকে। যাদের নিরলস শ্রম আর প্রচেষ্টায় এই করোনাকালেও আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের মানোন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন থামিয়ে দিতে পারেনি।
পরিশেষে,সীতাকুণ্ড সকল জনসাধারণের কাছে একই অনুরোধ- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে আমাদের সহযোগিতা করুন। আমাদের সেবা গ্রহণ করুন। আমাদের বাঁচতে দিন, যাতে আপনাদের বাঁচাতে পারি।

ডাঃ মোঃ নুর উদ্দিন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিরাপদ থাকুন।
জনসচেতনতায়-
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ,
সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম।