উপকূলে ২২৭ প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ, সীতাকুণ্ডকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা!

উপকূলে ২২৭ প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ, সীতাকুণ্ডকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা!
উপকূলে ২২৭ প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ, সীতাকুণ্ডকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা!

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

সীতাকুণ্ড উপকূলের ৬৫০৭ একর বনভূমিকে ‘বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা’ ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে। এই উপকূলের পাঁচটি মৌজায় দুই হাজার হরিণসহ ১০৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণি, ৯৮ প্রজাতির পাখি ও ২১ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের জন্য অধিগ্রহণকৃত জায়গার গাছ কর্তনের ফলে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণি সীতাকুণ্ড উপকূলে বিচরণ করায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বন বিভাগ। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সীতাকুণ্ড উপকূলকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের দুটি সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী চারটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে বন বিভাগ।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের মতো মিরসরাই এলাকাতেও ১৯৯৪ সালে তিন জোড়া হরিণ ছাড়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীর হওয়ার পর হরিণগুলো সীতাকুণ্ড উপকূলে চলে যায়। এখনও হরিণগুলো খুব ভোর ও সন্ধ্যাবেলায় দেখা যায়। এই হরিণসহ নানা প্রাণির বিচরণ আছে সীতাকুণ্ড উপকূলে। এগুলো রক্ষার জন্য বন অক্ষত রেখে পুরো এলাকাটিকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।’

বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ড উপকূলের চারটি বিটের পাঁচটি মৌজার ৬৫০৭ একর বনভূমিকে ‘গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা’ ঘোষণার প্রস্তাব দেয় বন বিভাগ। প্রস্তাবিত মৌজার পূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল, উত্তরে মিরসরাই উপজেলার ডোমখালী খাল, দক্ষিণে গুপ্তাখালী মৌজায় ১৯২৭ সনের বন আইনের ৪ ধারায় ১৬০১ একর, ৬ ধারায় ৩৫৭ একর এবং ২০ ধারায় ৪৫৪৭ একর মিলিয়ে ৬৫০৭ একরের বনভূমিগুলো রয়েছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবিত এই বনে হরিণসহ ১০৮ ধরনের বন্যপ্রাণি যেমন কোবরা, গোখরা, দারাশ, কেওটে সাপ, খেঁকশিয়াল, মেছোবাঘ আছে। এছাড়াও ৯৮ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। কেওড়া, বাইন, গড়া, গেওয়া, সুন্দরী, হারগোজাসহ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো প্রায় ২১ প্রজাতির বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম আছে এই বনে। এখনো সেখানে নিয়মিত হরিণের দেখা মিলে। কমপক্ষে ২ হাজার হরিণ আছে উপকূলীয় এই বনে। বনভূমি সংলগ্ন সাগরে বিরল ও মহাবিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বিচরণ ও প্রজনন করে। বনভূমির মধ্যে গুপ্তাখালী, গুলিয়াখালী, ছোট কুমিরা, বাকখালী খালে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণির অবাধ বিচরণ রয়েছে। প্রস্তাবিত বনভূমির একাংশ গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত পর্যটন এলাকা হিসেবে খুবই সুপরিচিত। সেখানে থাকা লবণাক্ত জলাভূমি দেখতে খুবই নান্দনিক যা উপকূলীয় এলাকার জন্য বিরল। এই সৈকত থেকে সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। যা দেখতে প্রচুর পর্যটক এই বনে যায়। যে কারণে পুরো এলাকাটি বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা করলে বেড়িবাঁধ ও বেড়িবাঁধের ভিতরে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ জনপদ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে ক্ষতি হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সীতাকুণ্ড উপকূলের বনভূমিকে জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত বন বিভাগের কর্মকর্তারা মতামত তুলে ধরে বলেন, ইকোপার্কের ক্ষেত্রে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম থাকায় জীববৈচিত্র ধ্বংসের সম্ভাবনা থাকে। আবার বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা করা হলে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যাবে। এতে জীববৈচিত্র রক্ষা পাবে। উপকূলীয় রেঞ্জের ২৩৫০০ একর বনভূমি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে জন্য অধিগ্রহণ করায় সেখানে গাছ কর্তন করা হয়েছে। যে কারণে এতদিন সেখানে বিচরণ করা প্রায় দুই হাজারটি হরিণ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণি প্রস্তাবিত বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে পুরো এলাকাটি বন্যপ্রাণির একমাত্র আবাসস্থল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। আবার পুরো এলাকাটি জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা করা হলে পর্যটন ব্যহত হবে বলেও মতামত তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে গুলিয়াখালী খালের দুইপাশে ১০০ একর এলাকাকে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত রেখে বাকি বনভূমিকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা করা যেতে পারে।

সভায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এগুলো হলো- প্রস্তাবিত ‘গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা’ ঘোষণার প্রশাসনিক ও টেকনিক্যাল তথ্য সমন্বয়ে কনসেপ্ট নোট তৈরি করতে হবে। যে নোটে ‘গুলিয়াখালী কোস্টাল বে-ভিউ ইকোপার্ক’ এর পরিবর্তে ‘গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা’ ঘোষণার যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে হবে। একই সাথে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান এর খসড়া তৈরির কথাও জানানো হয়। এ প্ল্যান তৈরির ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে বিবেচনা নিতেও নির্দেশনা দেয়া হয়।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে যে সভাটি হয়েছে সেখানে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা ঘোষণা নিয়ে পজেটিভ কথাবার্তা হয়েছে। মন্ত্রণালয় কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বন বিভাগ সীতাকুণ্ডের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বনভূমি রক্ষায় বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;