কী অপরাধ ছিল শিশু রাসেলের , কেন নির্মমভাবে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল ?

কী অপরাধ ছিল শিশু রাসেলের , কেন নির্মমভাবে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল ?

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার ।। 

আজ রোববার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিন। উনিশশ পঁচাত্তর সালের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর প্রিয় দশ বছরের আদরের ছোট সন্তান এই শেখ রাসেলকেও নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছিল। বাবা, মা, ভাই, ভাবি, আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে সেদিন শহীদ হয়েছিল শিশু রাসেল। ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী এবং সমাজ সমালোচক বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেলের নামানুসারে জাতির পিতা তাঁর অতি প্রিয় ছোট সন্তানটির নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল। যে সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময়ে তাঁকে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর অন্ধকার কারাগারে থাকতে হয়েছে। জন্মের পরে পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত পিতার আদর, ভালোবাসা, স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে যে শিশুটি তাকেই কি না ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারাতে হলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে। বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। প্রাণভয়ে বাড়ির কর্মচারীরা শেখ রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে খুনিরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও।’ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এএফএম মহিতুল ইসলামকে জাপটে ধরে সেদিন শিশু রাসেল বলেছিল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? রাসেল তখন কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল যে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’ এই বলে অন্য ঘরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে শেষ করে দিল বঙ্গবন্ধুর আদরের রাসেলকে।

ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে শেখ রাসেল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। ভাই-বোনের মধ্যে অন্যরা হলেনÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক শেখ কামাল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ জামাল এবং বোন শেখ রেহানা। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। বঙ্গবন্ধু পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন। বেঁচে থাকলে রাসেলের বয়স হতো ৫৬ বছর। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে কি তাকে বঙ্গবন্ধুর মত দেখা যেত? এমন লম্বা সৌম্য সুন্দর চেহারার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হতো? ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুলে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা শেখ রাসেল কি দেশের একসময় নেতৃত্ব দিত? হয়তো তাই, আর সে কারণেই ঘাতকেরা সেদিন জাতির পিতার সঙ্গে তাকেও হত্যা করে।

সব ধর্মেই নরহত্যা মহাপাপ। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও শিশু হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। নবী করীম (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিনে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিচার করা হবে, তা তাদের মধ্যে সংঘটিত রক্তপাত ও হত্যার বিচার। (বুখারি, মুসলিম) তাই যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে অবলীলায় শিশু হত্যা করছে তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত পথের অনুসারী এবং এ পথ গেছে জাহান্নামের দিকে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এসব লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তাদেরকে যখনই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কর না’ তখনই তারা বলেছেÑ ‘আমরা তো সংশোধনকারী মাত্র।’ (সূরা বাকারা-১১)। খুনিদের কাছে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বিবেক বুদ্ধি কোনোকিছুরই বালাই ছিল না, তারা পশু হয়ে গিয়েছিল।

পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে বাড়ির সবাই শহীদ শেখ রাসেলকে অনেক আদর করতেন। মা, ভাই-বোনদের পাশাপাশি দাদা-দাদিও খুব আদর করতেন, রাসেলকে পিতা বঙ্গবন্ধু একটু বেশিই আদর করতেন। কারণ জন্ম ও বেড়ে ওঠার একদম শিশুকাল থেকেই পিতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল ছোট্ট রাসেল। ওই ছোট্ট বয়সে বাবাকে বলতে গেলে চিনতই না। স্বাধীনতার পর ’৭৫ সাল পর্যন্ত হয়তো সে জন্যই প্রায় সময়ই সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেলকে নিজের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকেও রেহাই দেয়নি। কী অপরাধ ছিল তার? আসলে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের শহীদদের কারও কোনো অপরাধ ছিল না।

দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বাংলাদেশকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে খুনি খোন্দকার মোস্তাক, ফারুক, রশিদ, জিয়া চক্ররা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা সেদিন কোনো ব্যক্তিকেই হত্যা করেনি, তারা সেদিন হত্যা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, গণতন্ত্রকে, মানবতাকে। তা না হলে চার বছরের শিশু থেকে নববিবাহিত বধূ ও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তারা কীভাবে হত্যা করে? শুধু তারা হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এর যেন বিচার না হয় তার জন্য অবৈধ ক্ষমতা দখলদার খুনি মোশতাক-জিয়া ইনডেমনিটি আইন করে বিচারের পথ বন্ধ করে রেখেছিল।

শহীদ শেখ রাসেল হতে পারে আগামী দিনের শিশুদের প্রেরণা। জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতির পুত্র হয়েও যে সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে তার পথচলা শুরু হয়েছিল, সাধারণ মানের স্কুল, সাদামাটা জীবনযাপন, আর দশটা সন্তানের মতোই রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং পারিবারিক শিষ্টাচার ও আদব কায়দার যে উদাহরণ সে রেখে গেছে তা আগামী দিনের শিশুদের চলার পথের বিরাট এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

মাথাভর্তি কালো চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার শেখ রাসেলও যে বেঁচে থাকলে একদিন দেশের নেতৃত্ব দিতে পারত, ঘাতকরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। আর তাই বিশ^বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়ে নিষ্পাপ চেহারার স্নিগ্ধ দশ বছরের এমন এক মিষ্টি চেহারার শিশু বাচ্চাকে ব্রাশফায়ার করে তুলতুলে দেহটাকে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। তখন কেমন লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর আদরের রাসেলের! আর কেমনই লেগেছিল বর্বর নরপিচাশ ওই খুনিদের? ওদের কি বুক কাঁপেনি একবারও? কাঁপেনি; কারণ ওরা অমানুষ, ওদের পরিচয় ওরা খুনি। তাই ওরা বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী মহীয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং তাদের নবপরিণীতা স্ত্রীদের যাদের মেহেদির রঙে রাঙানো ছিল হাত তাদেরকে হত্যা করেছে। ওরা সেদিন হত্যা করেছে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে, শহীদদের রক্তে রঞ্জিত লাল সবুজের পতাকাকে।

কিন্তু খুনিরা শেখ রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করলেও ভাগ্যগুনে বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া তার দুই বোন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রদ্ধেয় শেখ রেহানা আজ দেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার বড় দুই বোন কী অমানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে আজ দেশকে উন্নয়নের পথে নিতে যে যাত্রা শুরু করেছেন, বেঁচে থাকলে শেখ রাসেলও তাদের বোনদের এই যাত্রায় শরিক থাকত। মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয় না।

খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ টিকে আছে এবং থাকবে। সেই আদর্শকে সামনে নিয়ে দেশকে পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। শহীদ শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। খুনিদের অনেকের ফাঁসি হয়েছে। খুনিদের আস্ফালন ধুলোয় মিশে গেছে। বাঙালি আজ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই শহীদ শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুসহ পরিবার পরিজনদের আত্মা কিছুটা শান্তি পাচ্ছে।

শহীদ শেখ রাসেলের ৫৬তম জন্মদিনে তার শিশুকালের দুরন্তপনা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতে একাকার হয়ে যাওয়া, পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রিন্স কোট বা ওভার কোট পরে হাতের আঙুল ধরে হেঁটে যাওয়া বা ঈদের জামাতে নতুন পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে ঈদগাহে যাওয়া বা বিদেশ সফরে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে কোনো বিষয়ের ওপর জানতে চাওয়া এসবেরই স্মৃতিকথা হতে পারত। কিংবা বড় হয়ে জগত বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো হওয়া বা হতে চাওয়ার ইতিহাস থাকত। তার সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের কালরাতে! বেঁচে থাকলে শহীদ শেখ রাসেল আজ বঙ্গবন্ধুর বয়সি হতো বা এক বছরের বেশি বয়সি থাকত।

এই পৃথিবীর আলো বাতাস, পৃথিবীর সৌন্দর্যের রূপরস, টুঙ্গিপাড়ার মধুমতী নদীর বদলে যাওয়া সৌন্দর্য আর বাঙালির অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে যে বেড়াত এখন সে কোথায় আছে? নাবালক শিশুবাচ্চা শেখ রাসেলকে খুনিরা হয়তো হত্যা করেছে কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে সে তার সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে গেছে এবং হয়তো তাঁর সুশীতল ছায়াতলে পিতামাতা ও স্বজনদের অপেক্ষায় আছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পরকালে তাকে হয়তো তার পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে উত্তম প্রতিদান জান্নাতুল ফেরদৌস দেবেন। মহান আল্লাহর দরবারে সেই ফরিয়াদ জানাই। শুভ জন্মদিন শহীদ শেখ রাসেল।

লেখক. রাজনৈতিক কর্মী