২০২০ মানবজাতির কাছে ছিল ‘বিষময়’, পৃথিবীতে এমন বছর আর যেন না আসে

২০২০ মানবজাতির কাছে ছিল ‘বিষময়’, পৃথিবীতে এমন বছর আর যেন না আসে
২০২০ মানবজাতির কাছে ছিল ‘বিষময়’, পৃথিবীতে এমন বছর আর যেন না আসে

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

২০২০ মানবজাতির কাছে ছিল ‘বিষময়’ । বছরটিকে বরণ করার সময় মনে হয়েছিল বিস্ময়ের বছর হতে চলেছে এটি। সুন্দর একটি সংখ্যা; যেন ছন্দের মতন। কিন্তু বছর জুড়েই আতঙ্ক, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা ছিল যার নিত্য সঙ্গী। অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়েছিল যে, মানুষ যত দ্রুত সম্ভব বছরটিকে বিদায় দিতে পারলেই যেন বাঁচে। ২০২০ এমন একটি বছর, যে সময়টাতে একটু নি:শ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করেছে মানুষ। এমন বিষাদময় বছর যেন নিকট অতীতে আসেনি মানুষের জীবনে।

মহামারির বছরগুলোর তালিকায়ও যুক্ত হলো ২০২০। প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে ভাইরাসের দাপটে ত্রস্ত পৃথিবীতে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে সরকারকে কঠোর হতে হয়েছে; ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে, অবরুদ্ধ করে দিতে হয়েছে একের পর এক এলাকা। বেশিদিন এভাবে চালানো না যাওয়ায় বদলাতে হয়েছে কৌশলও। মহামারী আর নানা বিধিনিষেধের কারণে বেড়েছে ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতি। আয় বৈষম্য যে বেড়ে গেছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

২০২০ বছরটিকে আমাদের জন্য একটা দুঃখের বছর বলা যায়। পৃথিবীর হিসাবে যদিও বাংলাদেশে করোনায় খুব বেশি মানুষ মারা যায়নি কিন্তু প্রিয় মানুষের মৃত্যুর হিসাবে এই বছরটি রীতিমতো অভিশপ্ত হিসেবে থেকে যাবে। এবছর প্রিয় মানুষগুলো শুধু মারা গেছেন তা নয়; তাদের মৃত্যুর পর শেষ শ্রদ্ধাটুকুও প্রদর্শন করতে পারিনি। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো করোনায় মারা যাননি; কিন্তু দায় ঘুরেফিরে করোনার ঘাড়েই পড়েছে।

৮ মার্চ প্রথম তিন জনের শরীরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। ততদিনে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক; লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধে গোটা দুনিয়া অচল করে দিয়েও থামানো যায়নি ভাইরাসের বিস্তার। ধনী বা গরিব- কোনো দেশই নতুন এ রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা বলয় গড়তে সফল হয়নি। মহামারীর সঙ্কটের শুরুতে পরীক্ষার ব্যবস্থা, সুরক্ষা সামগ্রী, হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটরসহ জীবনরক্ষাকারী কিছু চিকিৎসা উপকরণের অপ্রতুলতা ছিল। ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে ওঠা গেছে।

মার্চের শেষে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশেও লকডাউনের সেই ব্যবস্থা শুরু হয়। অবশ্য সরকারিভাবে একে বলা হয় ‘সাধারণ ছুটি’। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৭ মার্চ থেকেই। কওমি মাদ্রাসা বাদে অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা আছে। ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেই সঙ্গে সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়ায় বিশ্বের আরও অনেক দেশের মত বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষও ঘরবন্দি দশার মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে কষ্টে পড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ।

সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কল কারখানা বন্ধ থাকায় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ায় বড় ধরনের অর্থনৈতিক জটিলতার দিকে যেতে থাকে পরিস্থিতি। এর মধ্যেই কেটেছে ঈদ, পূজাসহ নানা ধর্মীয় উৎসব।

জীবন ও জীবিকার এই অসম সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অন্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও মে মাসের শেষ দিকে বিধি নিষেধ শিথিল করা শুরু হয়। গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। আগস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া শুরু হয়। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ভাবনা থেকে মাঝে পুরো দেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি এলাকায় সেই ব্যবস্থাও চালানো হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা এগোয়নি।

করোনাভাইরাস যখন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তখনও অপরাধ থামেনি; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি অভিযান আর প্রতারণা-জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনা বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিদায়ী বছরে। লকডাউনের মধ্যে দুই মাস চুরি-রাহাজানির মত অপরাধ কমে আসার খবর এসেছিল সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু পরে তা ছাপিয়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা আর ধর্ষণ-নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ার খবর।

প্রতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা থাকে একটি আলোচিত বিষয়। এ বছর ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় সিনহার বোনের দায়ের করা মামলায় ইতোমধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে র‌্যাব।

এ করোনা মহামারিতে রীতিমতো শিক্ষাঙ্গনেও ছিল স্থবিরতা। মুক্তিযুদ্ধের বছরের অর্ধশতক পর ২০২০ সালে এসে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে আবারও শিক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় পরের ক্লাসে তুলে দিতে হচ্ছে বাংলাদেশে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে ঘটা করে; নানা আয়োজনে আসবেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা – বছর জুড়ে জাতির জনকের জন্মোৎসবের বর্ণিল সব প্রস্তুতিই ছিল চ্থড়ান্ত। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস হানা দিলে সরকারকে পিছপা হতে হয়। বাহ্যিক সামাজিক সব আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত হলেও জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থগিত করা হয়। মহামারীর বাধায় উদযাপন বাধাগ্রস্ত হলেও আশা ছাড়েনি বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে মুজিববর্ষের সময়কাল ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ।

এক করোনায় পাল্টে গেছে মানুষের জীবন যাত্রা। জীবনের পদযাত্রা এখন মেপে মেপে চলতে হয় এক্কাদোক্কা খেলার মতন। দাগের একটু বাইরে গেলেই যেন বিপদ গ্রাস করবে। অজানা ভয় মানুষ লালন করে মনের মধ্যে। কে ঝুঁকি নিতে চায়? এত সুন্দর ভুবন থেকে কে চলে যেতে চায় ? কেউ চায় না। কিন্তু মৃত্যু অবধারিত, তা জেনেও বাঁচার কী আকুতি আমাদের! আমরা বাঁচতে চাই। নতুন বছরে রাত কেটে আসুক ভোর, ভোরের আলোয় জীর্ণ পুরাতন যাক খসে।