হঠাৎ টালমাটাল রডের বাজার, দাম বাড়ছে

হঠাৎ টালমাটাল রডের বাজার, দাম বাড়ছে

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ।।

রডের মূল্য দেশের বাজারে এখন ঊর্ধ্বমুখী। কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় দাম বাড়ছে পণ্যটির। এক সপ্তাহের ব্যবধানে শুধু পাইকারি পর্যায়েই পণ্যটির দাম বেড়েছে টনে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা।

দেশের ইস্পাতের চাহিদার বেশির ভাগ জোগান আসে চট্টগ্রাম থেকে। সাধারণত এ মৌসুমে দেশের নির্মাণ শিল্পে বেশ চাঙ্গাভাব দেখা যায়। যদিও করোনার কারণে গত কয়েক মাস নির্মাণসামগ্রীর বাজারে বেশ স্থবিরতা দেখা যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে যখন সবাই উদ্বিগ্ন তখনই আবারো গতি পায় নির্মাণ শিল্প। এরই ধারাবাহিকতায় দাম বাড়তে থাকে রডের। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে অস্বাভাবিক রকমের ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা দেয় পণ্যটির বাজারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রড ও রডের কাঁচামালের দরবৃদ্ধিও এক্ষেত্রে বড় একটি অনুঘটকের কাজ করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সাধারণ গ্রেডের রডের দাম। এ সময়ে প্রায় প্রতিদিনই দফায় দফায় বেড়েছে পণ্যটির দাম। বর্তমানে মিল গেটে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি টন সাধারণ গ্রেডের (৪০০ ওয়াট) এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ হাজার টাকায়, যেখানে এক সপ্তাহ আগেও মিল গেটে একই মানের রড বিক্রি হচ্ছিল ৫২ হাজার থেকে সাড়ে ৫৪ হাজার টাকার মধ্যে। সে হিসাবে এ সময়ের মধ্যে সাধারণ গ্রেডের রডের দাম বেড়েছে টনে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।

একই সময়ের মধ্যে সেমি অটো (৬০ গ্রেড বা ৫০০ ওয়াটের সিল থাকলেও যেসব রড সেমি অটো মিলে উৎপাদন হয়) এমএস রডের দাম টনে প্রায় ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে বর্তমানে প্রতি টন সেমি অটো রড বিক্রি হচ্ছে ৫৭-৫৮ হাজার টাকার মধ্যে, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৩ হাজার টাকার মধ্যে। চট্টগ্রামের বাজারে সাধারণ গ্রেড ও সেমি অটো এমএস রডের মধ্যে এসএআরএম ( সীমা স্টীল), খলিল, মজিদ, ভাটিয়ারি, এসএল, এমএসআরএম (মানতি), আম্বিয়া ব্র্যান্ডের রডের চাহিদা ও বিক্রি বেশি।

রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা জানান, গত সপ্তাহে রডের বাজারদর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সাধারণ মানের রডের দাম বেড়েছে বেশি। নির্মাণ শিল্পে চাঙ্গাভাবের কারণে বাজারে এখন এসব রডের চাহিদা বেশি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহের গতি কম হওয়ায় বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ছে দ্রুত। মূলত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়ের ক্রেতাদের মধ্যেই এ ধরনের রডের চাহিদা থাকে বেশি।

একই কথা বলছেন ব্যবসায়ীরাও। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও বিলেটের দাম ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে করোনার কারণে নির্মাণকাজে গতি ছিল কম। বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মাণকাজের গতি বাড়ায় চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে রডের দামও বেড়েছে।

সাধারণ গ্রেডের রডের পাশাপাশি ৬০ গ্রেড (৫০০ ওয়াট) এমএস রডের বাজারও কিছুটা বেড়েছে। বাজারে বর্তমানে প্রতি টন ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৬১-৬৩ হাজার টাকায়, যেখানে এক সপ্তাহ আগেও এর মূল্য ছিল টনপ্রতি ৫৬-৫৭ হাজার টাকা। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রডের দাম বেড়েছে টনে ২/৩ হাজার টাকা।

বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬০ গ্রেডের রডের মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর মধ্যে প্রতি টন বিএসআরএম রড ৬১-৬৩ হাজার টাকায়, কেএসআরএম ৬০ হাজার টাকায়, একেএস ৫৫ হাজার, এসএআরএম ( সীমা স্টীল) ৫৫ হাজার এবং আরএসআরএম ৫৫ হাজার, জিপিএইচ ৫৫ হাজার ও গোল্ডেন ইস্পাত ৫৫ হাজার এবং অন্যান্য ব্র্যান্ডের রড ৫৬-৬১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক ও কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ইস্পাত স্ক্র্যাপের তীব্র ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে ক্রমাগত বাড়ছে রডের দাম। স্ক্র্যাপের দাম বাড়ার কারণে রড়ের দামের উপর প্রভাব পড়ছে। আগে ২৮০ ডলার থেকে ৩০০ ডলারে স্ক্র্যাপ পাওয়া যেত। এখন সেটি বেড়ে গেছে ১০০ ডলারেরও বেশি।’

বিশ্ববাজারের পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চীন ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা তাদের দেশে স্ক্র্যাপ আমদানির অনুমতি দেবে— যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশঙ্কা করছি, চীন স্ক্র্যাপ আমদানি শুরু করলে বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনের বর্তমান সক্ষমতা বজায় রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। এখনই এই প্রভাব পড়েছে আমাদের স্থানীয় বাজারে।

শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘ইস্পাত খাতের শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর এমনিতেই রয়েছে বাড়তি করের বোঝা। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে রডের দাম নির্ধারণ না করা হলে ইস্পাত খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।’

জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলাম এফসিএ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে আগে কম দামে স্ক্র্যাপ পাওয়া যেত। এখন সেটি ১০০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। শীত মৌসুমে স্ক্র্যাপের সরবরাহ কমে যায়। কিন্তু রডের চাহিদা বেড়ে যায়। এর ফলে রডের দাম বাড়ে। তবে এবার স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে রডের দামও বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘চীনে স্ক্র্যাপ আমদানির খবর আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় স্ক্র্যাপের দামে প্রভাব পড়েছে। স্ক্র্যাপের র-ম্যাটেরিয়ালস কমে যাওয়ার ফলে স্ক্র্যাপের সরবরাহ কমে গেছে— এটাও দাম বৃদ্ধির একটি কারণ। স্ক্র্যাপের বড় চাহিদার দেশ হচ্ছে তুরস্ক। তাদের চাহিদা বেড়ে গেলেও স্ক্র্যাপের দাম বাড়ে। তবে এবার চীনের কারণে বাড়ছে স্ক্র্যাপের দাম— এমন কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শোনা গেলেও আমরা এখনও নিশ্চিত হইনি।’

বিএসআরএমের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও রডের দামে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। কারণ করোনার আগে আমরা যে দামে রড বিক্রি করেছি, এখনও সেই দামেই বিক্রি করছি। কিন্তু করোনার সময় রডের দাম কমেছিল। এখন সেটি একটু বেড়ে আগের সমান হয়েছে। লকডাউনের আগে যা দাম ছিল, সেটিই এখনও আছে। তবে নতুন স্ক্র্যাপ আসলে দামটা পুনঃনির্ধারণ হবে। রডের দামও আন্তর্জাতিক স্কেলের মধ্যে রাখতে হবে— যাতে ইস্পাত শিল্প বেঁচে থাকে।’

চট্টগ্রামের পাইকারি রডের বাজার আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রফিক উদ্দীন বলেন, মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে সাধারণ গ্রেডের রডের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি মিলগুলোয় সংকটের কারণে গত কয়েক দিনে রডের দাম আরো বাড়ছে। 

সরবরাহ সংকটের সুযোগে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন অন্য এক ব্যবসায়ী।

সীমা স্টিল (এসএআরএম ) পরিচালক পারভেজ উদ্দীন সান্টু বলেন, বছরের এই সময়টাতে কাঁচামালের দাম এমনিতেই চড়া থাকে। তাই রডের দাম বাড়া স্বাভাবিক। গত বছর রডের দাম ছিল ৫৭ হাজার টাকা। মাঝে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমার ফলে দেশের বাজারেও রডের দাম কমে ৪৬-৪৭ হাজার টাকায় নেমে এসেছিল। এখন আবার বাড়ছে। রডের দাম ওঠানামার পুরো প্রক্রিয়াটা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাছাড়া করোনা ঘিরে গত কয়েক মাসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। গত সপ্তাহ থেকেই পুরোদমে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় সাধারণ গ্রেডের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে কারখানাগুলোয় পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় উচ্চ গ্রেডের রডের দামে খুব একটা পরিবর্তন হবে না।