মাতৃভাষা চর্চার ইসলামে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মাতৃভাষা চর্চার ইসলামে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মাতৃভাষা চর্চার ইসলামে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

আব্দুস সালাম হুসাইন আলী।।

সৃষ্টিকুলকে ঘিরে রেখেছে আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার । তার কোনো নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভূক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ তায়ালা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত।

মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

الرَّحْمَٰنُ - عَلَّمَ الْقُرْآنَ - خَلَقَ الْإِنسَانَ - عَلَّمَهُ الْبَيَانَ

‘করুণাময় আল্লাহ। শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বর্ণনা। [সুরা আর-রহমান, ৫৫: ১-৪]

আলোচ্য আয়াতে মানুষকে উপস্থাপন-জ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে। মনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি, দু:খানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে।

আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় অগণিত মানুষ সৃষ্টি করেছেন। নিপূণতার সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে দিয়েছেন রংয়ের ভিন্নতা; ভাষার ভিন্নতা; দিয়েছেন রুচির বৈচিত্র্য। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ধরণ, রূপ-সৌন্দর্য ও ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তায়ালার অপরূপ মহিমা ও কুদরতের সাক্ষী। এসবই প্রমাণ করে আল্লাহ কত সুনিপূণ কারিগর। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেন। সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি; আল্লাহর দান।

وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

‘তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ [সুরা রুম, ৩০ : ২২]

মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হিদায়াতের জন্য তিনি যত নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা তাদের মাতৃভাষায় করেছেন।

﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ﴾

‘আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে’। [সুরা ইবরাহিম: ১৪ : ৪]

প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সাথে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহিয়ান করে তোলার জন্য প্রয়াস চালানো। তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে; স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করা হবে।

বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব
ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আরবের অধিবাসী, তাই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবি ভাষায়, তাঁর মাতৃভাষায়। তাই পবিত্র কুরআন ও হাদিসকে বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে, এটা সময়েরও অনিবার্য দাবি। কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলমান ধর্মপ্রাণ; কিন্তু বাংলা ভাষায় ইসলামের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌছানোর অভাবে তাদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না।

বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন; কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। ইসলামের সব বিষয়, সব দিক ও অধ্যায়ের ওপর মৌলিক ও অনুবাদের কাজ হলে বাংলাভাষী মুসলমানরা সহজেই ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পারবে এবং আমল করতে পারবে। বাংলা ভাষায় ইসলামের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তেমন কোনো বই বা রচনা নেই বললেই চলে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পারে না। বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা।

ইসলামের আদর্শ যেমন সার্বজনীন, ইসলামের ভাষাও তেমনি সার্বজনীন। এ কারণেই দেখা যায়, নবিজির ইন্তেকালের পর ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গেছেন, সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। মুসলমানরাই বাংলা ভাষাকে স্ব-মহিমায় সমুন্নত করেছেন। বস্তুত মুসলিম মননে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে ইসলামের মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্বের কারণেই।

যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের মধ্যভাগ হতে ৬৪০ খৃস্টাব্দের দিকে। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে ইসলাম প্রচারকগণ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য এসেছেন। তারা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেন। এ দেশের মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এমনকি বাংলা ভাষা এক দারুণ অবহেলিত অবস্থা থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয় মুসলমানদের আগমনের ফলে।