দলমত দেখা যাবে না ত্রাণের তালিকায়,কর্মহীন ৫০ লাখ মানুষ রেশন কার্ড পাবে: প্রধানমন্ত্রী

দলমত দেখা যাবে না ত্রাণের তালিকায়,কর্মহীন ৫০ লাখ মানুষ রেশন কার্ড পাবে: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবে সরকারি ত্রাণ বিতরণে, কর্মহীন হওয়া মানুষের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে দলমত না দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাঠ প্রশাসন ও দলের নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, দলমত নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে।

বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ঢাকা বিভাগের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন তিনি।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান ৫০ লাখসহ নতুন করে আরও ৫০ লাখ মানুষ রেশন কার্ডের আওতায় আসবে। এ কার্ডের মাধ্যমেই তারা সরকারি সহায়তা পাবে।

ত্রাণের তালিকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাজ করি জনগণের জন্য। কে কোন দল করল, কে কার পক্ষে, কে আমার পক্ষে না, কে আমার ভোটার, কে আমার ভোটার নাÑ সেটা দেখার দরকার নাই। যার অবস্থা খারাপ, দুস্থ, যার ঘরে খাবার নেই তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বলব, কে ভোট দিল তা নয়; জনগণ হিসেবে দেখে সেভাবে তালিকা করবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, নাম তালিকা করতে গিয়ে যারা সত্যিকারের দুস্থ, দরিদ্র, যার ঘরে খাবার নেই, তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের হাতে যেন সাহায্যটা পৌঁছায় সেই ব্যবস্থাটা করবার জন্য ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নির্দেশ চলে গেছে যাতে করে সঠিক নামটা আসে। নইলে অনেক সময় দেখা গেল যে নির্বাচিত প্রতিনিধি তারা তাদের কয়েকজন বাছা লোক দিল, কমিশনার তাদের ভোটারদের দিল, কেউ বাদ পড়ল। এই বাদটা যেন না পড়ে। প্রশাসনের যারা কাজ করবেন তারাও এটা নজরদারিতে রাখবেন। একজন মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। আল্লাহর রহমতে প্রচুর খাবার আছে।

দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমি চাই আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মী সেই মানসিকতা নিয়ে কাজ করবে। আর সেভাবে তালিকা করবে। ১০ টাকার চাল বা যারা হাত পেতে চলে না তাদের জন্য তালিকা করব সেখানেও যেন সঠিক তালিকাটা তৈরি হয় সেই নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকৃত অসহায় মানুষকে খুঁজে পেতে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন তিনি।

মানুষের কষ্ট লাঘবে দেওয়া ত্রাণে কেউ থাবা বসালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলের পক্ষ থেকে আমরা করে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরে আমরা যে সহযোগিতাটা দেব সরকারি হোক, বেসরকারি হোক বা বিত্তবানরা দেবে সেগুলো যেন সঠিক লোকের হাতে পৌঁছায়। সেখানে যেন কেউ অনিয়ম করতে না পারে। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ আমরা দিয়েছি। মানুষের কষ্ট লাঘবে আমরা সাহায্য দিচ্ছি। এই সাহায্যে কেউ থাবা দিক আমরা চাই না। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম হলে সেটা আমরা কিন্তু কখন বরদাশত করব না।

ষড়যন্ত্র করে একজন আরেকজনকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোথাও কোথাও আমরা দেখেছি যে কিছু কিছু জায়গায় আশপাশের লোক তারাই ষড়যন্ত্র করে একজন আরেকজনকে ফাঁসিয়ে দেয়। তদন্ত করতে গেলে দেখা যায় সেখানে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এই দুর্যোগের সময় কেউ কারও পেছনে এভাবে লেগে থাকবেন সেটাও কিন্তু আসলে ঠিক না। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।

আরও ৫০ লাখ রেশন কার্ড করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সব শ্রেণির মানুষকে সহযোগিতার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৫০ লাখ মানুষের রেশন কার্ড করা আছে। কর্মহীন আরও ৫০ লাখ মানুষের রেশন কার্ড করে সহায়তা দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, যেহেতু সবকিছু এখন বন্ধ। অনেক মানুষের কষ্ট হচ্ছে। যারা দিনমজুর কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, এমনকি নিম্নবিত্তদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। সবাইকে সহযোগিতা করব। এমনকি এটা আমরা শুরু করেছি। মানুষের কাছে হাত পাততে পারে না যারা, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা আরও ৫০ লাখ মানুষকে রেশন কার্ড করে দেব। ১০ টাকার ওএমএস চাল নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এটা স্থগিত করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেককে আলাদাভাবে কার্ড করে, কার্ডের মাধ্যমে দেওয়া হবে। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ যেন পায় সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সে জন্য আমরা এই কার্ড করে দেব। যাতে প্রত্যেকের ঘরে কিছু ত্রাণ পৌঁছে যায়।

রমজানে ঘরে তারাবি পড়ার অনুরোধ
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এবার রমজানে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে তারাবির নামাজ মসজিদে না পড়ার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের মুসলমানদেরও ঘরে বসে তারাবির নামাজ ও রমজানে ইবাদত করার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন সৌদি আরবে সেখানে পর্যন্ত মসজিদে নামাজ, জমায়েত হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি তারাবির নামাজও সেখানে হবে না, সবাই ঘরে বসে পড়বে। খুব সীমিত আকারে সেখানে করছে, তারা কিন্তু নিষেধ করে দিয়েছে। ঠিক এভাবে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, এমনকি ভ্যাটিকান সিটি থেকে শুরু করে সব জায়গায় এভাবে তারা সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা অন্যকে সুরক্ষিত করা এখান থেকে আমাদেরও শিক্ষার বিষয় আছে।

রমজানে ঘরে বসে তারাবির নামাজসহ ইবাদত করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারাবির নামাজ যেহেতু সৌদি আরবের মসজিদে বা অন্যান্য দেশেও হচ্ছে না, আমাদের এখানেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে কতগুলো নির্দেশনা দিয়েছে। সেটা আপনারা মেনে ঘরে বসে তারাবি পড়েন, নিজের মনের মতো করে পড়েন। আল্লাহকে ডাকতে হবে, ইবাদত করতে হবে। সেটা আপনি আপনার মতো করে যত ডাকতে পারবেন আল্লাহ সেটাই কবুল করবেন। কাজেই সেগুলো আপনারা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসজিদে না গিয়ে নিজের ঘরে বসে নামাজ পড়া; কারণ আল্লাহর ইবাদত, যেকোনো জায়গায় বসে ইবাদত করতে পারেন। এটাতে আল্লাহর কাছে সরাসরি আপনি করবেন। বরং এখন আল্লাহর কাছে ইবাদত করার ভালো একটা সুযোগ এসেছে। অযথা মসজিদে গিয়ে কেউ সংক্রমিত থাকলে সে অন্য কাউকে সংক্রমিত করবে, আপনার নিজের হলে অন্যকে করবেন। এটা কিন্তু করবেন না দয়া করে। এ বিষয়টা সবাই মেনে চলবেন। নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, অন্যকেও সুরক্ষিত রাখুন।

সামনে রমজান মাসে পণ্য পরিবহন বা খাদ্যসামগ্রীর যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সে জন্য সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় না যাওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

করোনা আক্রান্তদের প্রতি অমানবিক না হয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন : করোনাভাইরাস নিয়ে অমানবিকতার কোনো যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মায়ের একটু সর্দি-কাশি-জ্বর দেখে জঙ্গলে ফেলে আসা; এর চেয়ে অমানবিক কাজ আর হতে পারে না। এই অমানবিক হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারও যদি সন্দেহ হয় তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনেক সময় অমানুষেও পরিণত হয়। যখন আমরা দেখি মায়ের একটু সর্দি-কাশি-জ্বর হলো দেখে; ছেলে, ছেলের বউ, ছেলেমেয়ে মিলে এমনকি তার স্বামী পর্যন্ত তাকে নিয়ে জঙ্গলে ফেলে আসে! এর থেকে অমানবিক কাজ আর হতে পারে না। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। এ রকম আরও বহু কাহিনি আমরা শুনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কীভাবে একটা মানুষকে বের করে দেয়! একজন ডাক্তার অসুস্থ হলো তাকে এলাকা থেকে বের করে দিতে হবে! এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে বাংলাদেশে? বাংলাদেশের মানুষের তো এ রকম অমানবিক হওয়ার কথা না। এই বিষয়গুলো আমি সবার দৃষ্টিতে আনতে চাই।

করোনা নিয়ে অমানবিক না হয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অমানবিক হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারও যদি সন্দেহ হয় তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তার পরীক্ষা করান। নিজেরাও সুরক্ষিত হোন। আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলুন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। যেকোনো মানুষ যেকোনো দিন মারা যেতে পারে। আজকে আমি কথা বলছি, এখানে বসেও মরতে পারি। বা যে কেউ মরতে পারে। এটা কেউ বলতে পারে যে আমি বেঁচেই থাকব। একমাত্র আল্লাহ বলতে পারেন।

তিনি বলেন, ভাইরাস দেখা দিল, এ রকম একটা ভাইরাস এসে সারা বিশ^কে এ রকম ঘরবন্দি করে ফেলবে। এটা কি কেউ ভেবেছে। সারা বিশে^ অনেক শক্তিশালী দেশ, তাদের শক্তির দাপটে পৃথিবী অস্থির। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের লড়াই, সংঘাত, অস্ত্রের মহড়া আমরা দেখেছি। সেই অস্ত্র, অর্থ কোনো কাজে লাগে নাই, কোনো কাজে লাগবে না, সেটাই প্রমাণ করে দিল এই করোনাভাইরাস।

শেখ হাসিনা সবাইকে মানবিক ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কাজেই এইটুকু বলব সবাইকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। সাবধানে থাকতে হবে। তার মানে এই নয় যে অমানবিক আচরণ করতে হবে। সেটা আপনারা করবেন না।

তিন বছরের পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশে কোনোরকম মন্দা আসলে যাতে মোকাবেলা করা যায় সেই পরিকল্পনা বর্তমান সরকার নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আগামী তিন বছরের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, এই ভাইরাসের কারণে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে বিশ্ব জুড়ে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। এমনকি দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে।

তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় আছে। মন্দা হলে আমরা কীভাবে দেশকে রক্ষা করব এ কথা চিন্তা করে আমরা প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা বলতে গেলে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি করেছি এবং বাস্তবায়ন শুরু করেছি। শুধু এখনকার জন্যই নয়, আগামী তিন অর্থবছরে আমরা কীভাবে দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা করব সেই পরিকল্পনাও আমরা নিচ্ছি। আমরা আগাম কিছু কর্মসূচিও নিচ্ছি।