দ্বিতীয় এলিজাবেথের ১ম ভারত সফর , রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত প্রায় দশ লাখ লোক জমায়েত!

দ্বিতীয় এলিজাবেথের ১ম ভারত সফর , রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত প্রায় দশ লাখ লোক জমায়েত!
দ্বিতীয় এলিজাবেথের ১ম ভারত সফর , রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত প্রায় দশ লাখ লোক জমায়েত!
পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে যখন প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষ সফরে আসেন তখন দিল্লি বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ভারতের রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত প্রায় দশ লাখ লোক জমায়েত হয়েছিল। সেদিন মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
সেখানে বলা হয়, 'ভারতীয়রা সপ্তাহের সকল কাজকর্ম বাদ দিয়ে জড়ো হয়েছেন। অতীতের অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক কলহসহ প্রায় সকল সমস্যা ভুলে গিয়েছিল।' প্রকৃতপক্ষে এই কথাগুলোর গভীরতা ব্যাপনভাবে উপমহাদেশে উপনিবেশিক ব্রিটিশদের সময়কালকে ইঙ্গিত দিতো। যাই হোক, সেদিন ট্রেন, বাস এবং গরুর গাড়িতে করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রানিকে দেখতে মানুষ দিল্লিতে পাড়ি জমায়। রানি এবং প্রিন্স ফিলিপকে একবার দেখার আশায় ভারতীয়রা দিল্লির পথেঘাটে ঘুরতে থাকে।

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
কিন্তু ওই একই সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস অন্য আরেকটি সংবাদে লেখে, রানি এলিজাবেথ তাদের পুরনো একটি সাম্রাজ্য সফরে একজন পৃষ্ঠপোষক শাসক হিসেবে আসেননি।' তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত প্রথম শাসক। ওই সফরের মধ্যদিয়ে ভারতীয়রা ফের কোনো ব্রিটিশ শাসককে দেখার সুযোগ পান। যারা কিনা শত শত বছর ধরে ভারতীয় ভূখণ্ডে থেকে এখানকার সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আবার ভারতের সামনেও সুযোগ ছিল ব্রিটেনের বিদায়ের পর নিজেদের সক্ষমতা, উন্নতি এবং অগ্রযাত্রাকে মেলে ধরার। কারণ ভারত ততদিনে জেট বিমান, আধুনিক পাকা বাড়ি, সুউচ্চ অফিস ভবন, স্টিল মিল এবং পারমাণবিক চুল্লির যুগে প্রবেশ করেছে।

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
রানি এবং প্রিন্স ফিলিপের ভারত সফরের ব্যাপ্তি ছিল সর্বমোট ৬ সপ্তাহের। তবে তারা হয়তো ভাবতে পারেননি উপমহাদেশের মানুষ তাদেরকে এভাবে সাদরে গ্রহণ করবে। ফুলেল অভ্যর্থনা দিবে। সেবার রানি বোম্বে, মাদ্রাজ এবং কোলকাতা শহর ভ্রমণ করেন। তাজমহল, জয়পুরের গোলাপী প্রাসাদ এবং প্রাচীন শহর বারাণসী পরিদর্শন করেন। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যোগদান করেন। সেকালের সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে দেখা যায়, রানি একটি প্রাচীন রাজকীয় শিকারের লজে দুই দিন কাটিয়ে পরে হাতির পিঠে চড়েছিলেন। এছাড়াও শেষে ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন রানি এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপ।

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
তৎকালীন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি রাজধানী দিল্লির ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে হাজার হাজার উচ্ছ্বাসিত লোকের সমাবেশে ভাষণ দেন। এছাড়াও ভিঁড়ের মাঝখানে ছাদ খোলা গাড়িতে চড়ে গিয়েছিলেন আগ্রার তাজমহল দেখতে। শুধু তাই নয়, রানি কোলকাতায় পৌঁছে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত একটি ইস্পাত কারখানা পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কোলকাতায় রানির ওই সফরকে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। সেখানে তিনি রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করেন। কোলকাতা সরকার রানির প্রতি সম্মান জানাতে স্থানীয় রেসকোর্স ময়দানে একটি ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করে।

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
ঘোড়দৌড়ে বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন রানি নিজে। তবে অনেক ভারতীয় মনে করেন রানি এলিজাবেথ দিল্লিতে যে গণজোয়ার দেখেছিলেন তার চেয়ে বেশি উৎসবমুখর পরিস্থিতি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কোলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই একটি ছাদ খোলা গাড়িতে চড়ে পুরো শহরে প্রদক্ষিণ করেন তিনি। সেদিন ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এআইএল রানির সফরের সকল কার্যক্রম সম্প্রচার করে। এআইআর-এর একজন প্রতিবেদক ইয়র্কশায়ার পোস্টে লিখেছিলেন, 'রানি হয়তো ভারতের সম্রাজ্ঞী নন, তবে তিনি সেকালে জনতার উৎসাহ এবং আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন। ওই ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন রানি এখনও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী।' 

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
ওই সফরের প্রায় ২ দশক পর কমনওয়েলথ নেতাদের একটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ফের ভারতবর্ষে আসেন। সময়টা ছিল ১৯৮৩, তখন ভারতের মসনদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ওই সফরে রানি এলিজাবেথ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের ভিজিটর স্যুটে অবস্থান করেন। একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে, বিভিন্ন অফিস এবং জাদুঘরে পাওয়া ধূলিময় ঐতিহাসিক আসবাবপত্রগুলোকে মেরামত করা হয়েছিল। তারপর ওই কক্ষটি সাজানো হয় রানির জন্য। ওই কক্ষে শোভা পেতো লিনেন বেড, পর্দা এবং ভারতের ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ। এছাড়াও রানির খাবারের মেন্যুতে পুরনো পশ্চিমা রান্না যোগ করা হয়। কারণ তার পছন্দ ছিল সাধারণ খাবারদাবার। 

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
যাই হোক, ওই জায়গাটি পরিদর্শনের আগে রানি একটি ভোজ অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে অতীতে কিছু কঠিন ঘটনা ঘটেছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ আমি আগামীকাল পরিদর্শন করব, এটি ইতিহাসের একটি দুঃখজনক উদাহরণ। কিন্তু ইতিহাসকে পুনঃলিখন করা যায় না, আমরা মাঝে মাঝে যতই চেষ্টা করি না কেন। ইতিহাসের দুঃখের মুহূর্ত আছে, সেই সাথে আনন্দেরও। আমাদের অবশ্যই দুঃখ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং আনন্দকে গড়ে তুলতে হবে।'

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
তার ওই বক্তৃতায় ব্রিটেনের কাছ থেকে সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার নজির স্থাপন করেনি। রানির আগমনকে কেন্দ্র করে অমৃতসর বিমানবন্দর অভিমুখে ১৯১৯ সালে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে। তবুও শেষপর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের তুলনায় রানিকে দেখতে আসা লোকের সংখ্যাই বেড়ে যায়। গোটা অমৃতসর ভুলে যায় ৮০ বছর আগের নৃশংসতার কথা। সেদিন বিমানবন্দর সড়কে ১০ মাইল রাস্তায় জনস্রোত তৈরি হয়েছিল। রানিকে শিখ ধর্মের পবিত্র উপাসনালয় গোল্ডেন টেম্পলে জুতা খুলে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। রানির পোশাকপরিচ্ছদ নিয়েও মেতে থাকতো ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। হয়তো রানি ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার বদলে ৩ বার ভারতের ভূখণ্ডে ভ্রমণ করে দায় সেরে গিয়েছেন। কিংবা তিনি ক্ষমার পুরো বিষয়টি ভারতবর্ষকে ভুলিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তীতে একবার রানি বলেছেন, 'ভারতীয় জনগণের অতিথিয়েতা ও ভারতের সমৃদ্ধি, সেই সাথে ভারতের বৈচিত্র্য আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।'

ছবি: ইন্টারনেট

ছবি: ইন্টারনেট
তর্কাতীতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী উপনিবেশিক সাম্রাজের মহান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) মৃত্যুবরণ করেন। বিবিসির বরাত দিয়ে বাকিংহাম প্যালেস জানায়, রানি এদিন সন্ধ্যায় ব্যালমোরালে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর সারাবিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেই সাথে ব্রিটিশ শাসনের নৃশংসতা এবং লুটপাট নিয়েও তীব্র আলোচনা শুরু হয়। ভারতকে শোষণ ও লুটপাট করা ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে রানি তার জীবদ্দশায় ক্ষমা চাননি। -তথ্যসূত্র: বিবিসি ।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;