করোনাকালীন সময়ে শিশুর টিকা যথাসম্ভব সঠিক সময়ে দেওয়া জরুরি-এমরান চৌধুরী

করোনাকালীন সময়ে শিশুর টিকা যথাসম্ভব সঠিক সময়ে দেওয়া জরুরি-এমরান চৌধুরী
করোনাকালীন সময়ে শিশুর টিকা যথাসম্ভব সঠিক সময়ে দেওয়া জরুরি

এমরান চৌধুরী ।।

‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত একটি স্লোগানের নাম। এই স্লোগানটির সঙ্গে পরিচিত নন কিংবা শোনেননি এমন মানুষ মনে হয় একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধরা যাক, আপনি কোনো এক গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন চোখ বাড়ালেই দেখতে পাবেন গাছের গায়ে সাঁটা কোনো টিনের প্লেট, আর তাতে লেখা —আপনার শিশুকে টিকা দিন। আপনার সামনে দিয়ে টুংটাং শব্দ করে চলে গেল একটি রিকশা। আর রিকশার পেছনে সুন্দর একটি বাচ্চার ছবি সহ শোভা পাচ্ছে আপনার শিশুকে টিকা দিন। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ক্লাব আপনি যেখানেই যান না কেন সেখানেই দেখবেন একই স্লোগান। আগুন জ্বালাতে গেলেন, হাতে নিলেন একটি ম্যাচ আর তার অপর পিঠেই লেখা আপনার শিশুকে টিকা দিন। এভাবে স্লোগানটি হয়ে ওঠেছে সবার কাছে পরিচিত, আদৃত।

অন্যদিকে গ্রাম বাংলার তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের নিরলস, নিরন্তর ও আন্তরিক প্রয়াসের মাধ্যমে এই স্লোগান পৌঁছে দিয়েছেন বস্তি এলাকা থেকে আলীশান দালানে। শুধু তাই নয়, এই স্লোগানের সুফল থেকে যাতে বাংলাদেশের একটি শিশুও বাদ না পড়ে তার জন্য প্রয়োজন ছিল মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণ। এই কাজটি ছিল সবচেয়ে জটিল ও কঠিন। কারণ সমাজে কিছু মানুষ বরাবরই নেতিবাচক ও পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারণায় নিমজ্জিত থাকে। তাঁদের সেই অনালোকিত জগত থেকে তুলে আনতে লাগে নানা যুক্তি ও সমাজের আলোকিত মানুষের সমর্থন। আবার বিষয়টি খুব একটা সহজ ছিল না। আর এই মোটিভেশান কাজে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সব সময় সহযোগিতা করে এসেছেন সমাজের সচেতন মানুষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। বিশেষ করে এনজিও হিসেবে ব্রাকের নাম উল্লেখ করতেই হয়। এ ছাড়া এই দুরুহ কর্মে যাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করতে হয় তাঁরা হলেন স্থানীয় শিক্ষিত সমাজ, সচেতন তরুণ-তরুণী, স্কুল, কলেজে, মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, এলাকার নানা সংগঠনের পদস্থ কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ। সবচেয়ে বড় কথা এই স্লোগান এতই পরিচিত ও জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি শিশুর সুস্থ, নিরোগভাবে বেড়ে ওঠার প্রশ্ন। বাঁচা মরার প্রশ্ন। কোনো মা-বাবাই চান না তাঁদের ফুটফুটে শিশুটি অকালে ঝরে পড়ুক। আমাদের দেশে এক সময় তাই হতো। ছয়টি রোগে বিপুল পরিমাণ শিশু মারা যেত। অথচ এই ছয়টি রোগই ছিল টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগ।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ( ইপিআই) শুরু হওয়ার পর থেকে টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহে শিশু মৃত্যর হার কমে আসতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে এই কর্মসূচির সাথে সংযুক্ত হয় আরও তিনটি টিকা। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুরে হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। কমে এসেছে নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার। ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার ছিল প্রতি লক্ষে জীবিত জন্ম ১৯৪ জন। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭০-এ। একইভাবে নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ২৯ জনে হ্রাস পেয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যু ৬৫ থেকে কমে ৩৬ জনে নেমে এসেছে (তথ্যসূত্র :সচিত্র বাংলাদেশ, জানুয়ারি ২০১৭) স্বাস্থ্য খাতে এসব যুগান্তকারী সাফল্যের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে আমাদের দেশ পোলিওমুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রধানও পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে অসাধারণ সাফল্যের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পেয়েছেন সাউথ সাউথ পুরস্কার’। পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ২০১৪ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য কর্তৃক অর্জন করেছে ‘পোলিও নির্মূল সংক্রান্ত সার্টিফিকেট’।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে এমন এক মহামারী যাতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে ভয় পাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাঁদের প্রাণ স্পন্দন কোলের শিশুদের নিয়ে বের হওয়া মা ও শিশুর জন্যে মোটের ওপর কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যদিও বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে যা দেখা যাচ্ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের তালিকায় মা ও শিশুর সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবু সাবধানের মার নেই। এক রোগ থেকে বাঁচাতে গিয়ে শিশু, শিশুর মা এবং শিশুর অভিভাবক বিপদগ্রস্ত হোক তা কেউ চাইবেন না। ফলে মার্চের শেষের দিক থেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যখন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে তখন থেকে শিশুর টিকাপ্রাপ্তির সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। কোনো কোনো এলাকায় টিকাদান বন্ধও রাখতে হয়। এই সমস্যা শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বব্যাপী ঘটেছে। এমতাবস্থায়ও ইউনিসেফ টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে বলেছে। কারণ টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহের জন্য যদি শিশুদের সময়মতো টিকা দেওয়া না যায়, তাতে এই রোগসমূহে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে আশঙ্কাজনকহারে।

করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে সারাদেশে অনেক শিশু টিকাদান শুরুই করতে পারেনি। কোনো কোনো শিশু এক ডোজ বা দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর আর দিতে পারে নাই। এই দিতে না পারার কারণ হতে পারে করোনা ভাইরাসজনিত ভীতি কিংবা টিকাদান কেন্দ্র বন্ধ থাকা। লকডাউনের কারণে কোনো কোনো এলাকায় টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আবার টিকাদান কেন্দ্রের দূরত্ব এবং যাতায়াত অসুবিধার কারণে অনেক শিশু ড্রফ আউট বা লেফট আউট এ পড়েছে। যে কারণেই হোক যে সব শিশু টিকা শুরু করতে পারেনি কিংবা আংশিক টিকা পেয়েছে ঐ সব শিশুদের সিডিউল অনুযায়ী সবকটি টিকা দেওয়া জরুরি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা মহামারী থেকে মানুষ কখন মুক্তি পাবে? আদৌ মুক্তি পাবে কিনা তা কেউ নিশ্চিত করে বলা দূরের কথা, অনুমান করাও সম্ভব নয়। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায কলেরা, বসন্তের মতো মরামারী যেমন যেতে সময় লেগেছে, করোনা মহামারী যেতেও সময় লাগবে যতক্ষণ না কার্যকর টিকা বাজারে না আসে। আর তাই ততদিন আমাদের করোনা ভাইরাসকে সাথে করে পথ চলতে হবে। তবে আমাদের সদা সতর্ক ও সচেতন থাকতে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে। বিশেষ করে শিশুকে টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। টিকা দিতে যাওয়ার আগে বাড়ির বড়দের কেউ একজন আগে থেকে গিয়ে টিকাদান কেন্দ্রের সার্বিক অবস্থা দেখে আসতে হবে। টিকাদান কেন্দ্রে যে সময় ভিড় কম থাকে সেই সময়, বিশেষত দুপুরের দিকে যাওয়া উচিত। টিকা দিতে যাওয়ার দিন শিশুর সঙ্গে মা অথবা বাবা বা অভিভাবক ছাড়া আর কারও যাওয়া উচিত নয়। বড়দের অবশ্যই মাস্ক পরে যেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যিনি টিকা দিচ্ছেন তিনি মাস্ক এবং গ্লাভস তথা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকা দিচ্ছেন কিনা? শিশু মাস্ক পরতে না চাইলে তার নাক-মুখ ওড়না বা শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে ঢেকে রাখতে হবে। টিকা কেন্দ্রে গিয়ে অযথা কারও সঙ্গে আলাপ বা গল্পগুজব করা যাবে না। টিকাদান কেন্দ্রের আসবাবপত্র বা কোন কিছু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেকোনো ধরনের ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। টিকা দেওয়া শেষে দেরি না করে বাড়িতে বা বাসায় ফিরে আসতে হবে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে অসুস্থ শিশুকে টিকা দেওয়া যাবে না। শিশুর জ্বর কাশি থাকলে তা থেকে সেরে না ওঠা পর্যন্ত কোনো টিকা দেওয়া যাবে না।

একদিকে করোনা সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে কলিজার টুকরোকে যথাসময়ে টিকা দিতে না পারার উদ্বেগ এই নিয়ে চলছে যাদের ঘরে সোনামনি আছে তাদের দৈনন্দিন জীবন। এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝামাঝি তৃতীয় দ্ব›দ্ব, কোনো কোনো শিশুর পেরিয়ে যাচ্ছে টিকার সিডিউল সময়। সৃষ্টি হচ্ছে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশ, টিটেনাস, যক্ষা, পোলিও, নিউমোনিয়া, হাম ও রুবেলার মতো রোগের ঝুঁকি। মনে রাখতে হবে এসব রোগের ঝুঁকি করোনা সংক্রমণের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই শিশুদের এই করোনাকালে যথাসময়ে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক