আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সাগর উপকূলের বনভূমি ইজারা, কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ

আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সাগর উপকূলের বনভূমি ইজারা, কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ
আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সীতাকুণ্ডের সাগর উপকূলে বনভূমি ইজারা, কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপনের জন্য সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুরের সাগর উপকূলে তুলাতলী মৌজার ৭ দশমিক ১০ একর জমি বিবিসি স্টিলকে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। তখন বন বিভাগ তাতে আপত্তি দেয়। আর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় বন বিভাগের এই জমি সংরক্ষণের আদেশ দেন। যা উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ফের দুই বছর পর এই জমির পাঁচ একর কোহিনূর স্টিলের নামে ইজারা দিয়েছে।

এই ইজারা নিতে ওই জমি তুলাতলী মৌজার পরিবর্তে দেখানো হয়েছে উত্তর সলিমপুর মৌজা হিসেবে। যা বড় ধরনের কারচুপি ও জালিয়াতি বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ আবদুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘ইজারা দেওয়া জায়গার বেশির ভাগই তুলাতলী মৌজার। মূলত উপকূলীয় বনের জায়গা এটি। পুনরায় বনের জায়গা ইজারা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে মাসখানেক আগে জেলা প্রশাসন বরাবর একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটি চিঠির জবাবও দেয়নি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।’ আদালতের রায়ের আদেশ উল্লেখ করে ইজারা বাতিলের জন্য সর্বশেষ আরও আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির উত্তরও দেওয়া হয়নি। অথচ জেলা প্রশাসনকে ওই বনভূমি রক্ষার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

বন বিভাগের অভিযোগ, কাগজপত্রে উত্তর সলিমপুর লেখা হলেও বেশির ভাগ জায়গা পড়েছে তুলাতলী মৌজায়। তুলাতলী জাহাজভাঙা কারখানার ঘোষিত অঞ্চল নয়। এ কারণে কৌশলে পুরোটাই উত্তর সলিমপুর মৌজা দেখিয়ে বন বিভাগের কেওড়াবনের পাঁচ একর ভূমি ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, উত্তর সলিমপুর ও তুলাতলী মৌজায় উপকূলীয় বন বিভাগের ১৯৪ একর বনায়ন রয়েছে। বন বিভাগ ইতোমধ্যে কোহিনূর স্টিলকে দুটি নোটিস দিয়ে বনের জায়গা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলেছে। চূড়ান্ত নোটিস দিয়ে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

জানা গেছে, ইজারা পাওয়া কোহিনূর স্টিলের মালিক মো. আবুল কাশেম ওরফে রাজা কাশেমের স্ত্রী কোহিনূর আকতার। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোহিনূর স্টিলের নামে সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর মৌজা দেখিয়ে পাঁচ একর বনভূমি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।

কোহিনূর স্টিলকে দেওয়া একসনা ইজারার চুক্তিনামায় জেলা প্রশাসকের পক্ষে সই করেন সীতাকুণ্ডের ইউএনও মো. শাহদাত হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম। দ্বিতীয় পক্ষে ছিলেন কোহিনূর আকতার। এর আগে ওই জায়গা ইজারা দেওয়া হয় বিবিসি স্টিলের নামে। যার স্বত্বাধিকারীর নামও মো. আবুল কাশেম ওরফে রাজা কাশেম।

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড ইউএনও শাহদাত হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্ট যে জায়গাটির বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে কোহিনূর স্টিলকে তা দেওয়া হয়নি। বিবিসি স্টিলের সেই সাত একর আমরা সংরক্ষণ করেছি। ওটা সংরক্ষণ করে এর বাইরে পাঁচ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। এখন তারা পাঁচ একরের বাইরে নতুন করে গাছপালাসহ দখল করেছে কি না, সেটা দেখতে হবে। জায়গাটি তুলাতলী, নাকি উত্তর সলিমপুর মৌজা, ঠিক মনে নেই।’

কোহিনূর স্টিলের ইজারা বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে ফাইল দেখে বলতে হবে। ফাইল দেখে বিস্তারিত জেনে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ফৌজদারহাট টোল সড়ক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে তুলাতলী মৌজার বনাঞ্চল কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে কোহিনূর স্টিল কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যেখানে কেওড়াবন কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ঘেরাওয়ের ভেতরও অনেক গাছপালা রয়েছে। জাহাজভাঙা কারখানার জন্য সাগর ভরাট করে অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। সংরক্ষিত এলাকায় টাঙানো হয়েছে সাইনবোর্ড। প্রতিষ্ঠানের লোকজন সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছেন সেখানে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাশেম ওরফে রাজা কাশেম বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে বিবিসি স্টিল উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। কোহিনূর স্টিলের বিষয়েও বন বিভাগ ছাড়পত্র দিয়েছে। জেলা প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে। ওই জায়গাটিতে তুলাতলী মৌজায় পড়েনি। মেপে দেখতে পারেন। ওখানে আমি কিছু গাছ লাগিয়েছি। এখন ঘেরাও দিয়ে রেখেছি। এ নিয়ে পত্রিকায় যত পারেন লিখুন। কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না। এবার পারলে বেলা মামলা করুক। বেলাকে আমি কেয়ার করি না।’

নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বিবিসি স্টিলের ইজারা বাতিল হওয়ার পর ২০২০ সালেই নতুন করে ১০ একর ভূমির জন্য আবেদন করা হয় কোহিনূর স্টিলের নামে। তখন সীতাকুণ্ড ইউএনও মিল্টন রায় ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম এ নতুন আবেদনের ওপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেতিবাচক মত দেন।

তারা ওই এলাকাটি বনের জন্য নোটিফিকেশনকৃত উল্লেখ করে হাইকোর্টের রায়ে তা সংরক্ষণের আদেশ দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন। পরে এই দুজন সীতাকুণ্ড থেকে বদলি হয়ে যান। এ ছাড়া আবেদনের পর একই সময়ে এ বিষয়ে বন বিভাগের কাছে ইজারার বিষয়ে কোনো আপত্তি ছিল কি না, জেলা প্রশাসন থেকে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তখন বন বিভাগ থেকে আপত্তি বা অনাপত্তি কোনোটাই জানানো হয়নি। তখন ডিএফও ছিলেন এস এম গোলাম মওলা।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে উত্তর সলিমপুরের পাশের তুলাতলী মৌজার ৭ দশমিক ১০ একর জমি বিবিসি স্টিলকে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। সে সুবাদে ওই এলাকার ১৯২ একর ভূমি জবর দখল করে ঘেরা-বেড়া ও রাস্তা তৈরি করেন রাজা কাশেম। ওই সময় বন বিভাগ আপত্তি দেয়। এমনকি বন আইনে মামলাও দায়ের করে বন বিভাগ। প্রথমবারের ইজারা বাতিলের জন্য ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বেলা জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে মামলা করে।

২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ওই মামলার রায়ে ইজারা কার্যক্রমকে আইনি কর্তৃত্ববিহীন ও আইনগতভাবে ভিত্তিহীন ঘোষণা করা হয়। একই আদেশে বনভূমি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তা না করে ভিন্নভাবে আবারও ইজারা দেওয়া হয়েছে।

নতুন করে ইজারা ও আইনি নোটিস দেওয়া প্রসঙ্গে বেলার আইনজীবী হাসানুল বান্না বলেন, আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে একই জায়গা আবার ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। অথচ আগের মামলার রায়ে আদালত বন ধ্বংসকারী এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। জাহাজভাঙা কারখানার যাবতীয় কার্যক্রম সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এই ইজারা আদালত অবমাননার শামিল। আমরা ইতিমধ্যে এ নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছি । সময়ের আলো।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;